আসছে বছর
ওসমান মিঞার ছয় ছেলে এক মেয়ে। বাড়ী জয়নগর। ওসমান মিঞা কলকাতায় বাবুদের বাড়ী মজুর খাটে। দিনের শেষে যা মজুরী পায় তা দিয়ে এক কিলো চাল কেনে। ওর একটা মাটির হাড়ী, একটা সরা আর একটা কাঠের হাতা আছে। এই দিয়ে সে কলকাতার সংসার চালায়।
সন্ধ্যে বেলায় জোগাড় করে আনা কাঠ কুটি দিয়ে ভাত ফুটিয়ে নেয়। বাজারের তরকারী ওয়ালার থেকে চারটে কাচালংকা আর মুদি দোকান থেকে একটু নুন চে্য়ে নেয় সে প্রতিদিন। তাই দিয়ে সে রোজ এক কিলো চালের ভাত খেয়ে প্ল্যাটর্মে শুয়ে পড়ে।
একদিন তরকারীর দোকান থেকে কাচালংকা চাইতে গিয়েছিল। দোকানদার বল্ল
কি ভাই মিঞা সাহেব এভাবে কতকাল কাচালংকা আর নুন ভাত খেয়ে কাটাবে? শরীরের পুষ্টি ও তো দরকার নাকি? একটু দুধ ও খেতে পার নাকি?
কেন, নিমাই দাদা, আমিতো একদম ঠিক আছি। পেটভরে খেয়ে হজম করে দিতে পারলেই শরীরে কোনো কিছু হয়না।
আচ্ছা ওসমান, তোমার দেশেতো শুনেছি ছটা ছেলে আর একটা মেয়ে আছে। তোমার বৌওতো আছে তারা কি খাচ্ছে ভেবে দেখেছ কখোনো? তুমি দেশে গেলেই পরের বছর তোমার কোলে একটা করে খোকা হয়। এই করতে করতে তোমার ছ ছটা ছানা আর একটা ছানি।আবার আসছে বছর একটা ছানার চেষ্টা করছ নাকি।
ওসমান দেতো হাসি হেসে বল্ল হে হে, সব ই আল্লার দান। দেখা যাক কি হয়।
দাদা দেশে আমার দুকাঠা জমিতে বাড়ী আছে। বৌকে একটা ছাগল,আর দশটা করে হাস মুরগী কিনে দিয়েছি।
ছানারা ছাগলের দুধ খায়, বৌ আমার বাড়ী বাড়ী মুড়ী ভাজে, আড়াইশো করে মুড়ি আর পাচটা করে টাকা পায়। একটা ডোবামত করে দিয়েছি। তাতে পুটি মোরলা আর তেলাপিয়া মাছে ভর্তি। বড় ছানাটা ছাকনী জাল দিয়ে মাছ ধরে। সকালে ছাগলের দুধ আর মুড়ি খেয়ে খিচুড়ী স্কুলে যায়। সেখানেও তো ওরা খাবার পায়। বৌটা আমার খুব পয়মন্ত জানো দাদা। উঠোনে চাষবাষ করেছে। সেখান থেকে আনাজের
কাজটা হয়ে যায়। তা ভাবছি এবারে বড়ো ছেলেটাকে নিয়ে আসবো।
সে এখানে এসে কি করবে?
ওকে ভাবছি কাগজ ওয়ালার কাজ করাব। বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাগজ কিনে ওই গাজীর দোকানে বিক্রি করবে। গাজী ভালো পয়সা দেয়গো দাদা।
পরের সপ্তাহে ওসমান বড়ো ছেলেটাকে নিয়ে এল। সে এখন সকাল থেকেই ফেরি করে বেড়ায়।
ট্রেনে করে অনেক দূরেও যেতে শিখে গেছে। বাপ ছেলে মিলে আয় করা শুরু করলো।
আব্বা অনেকদিন দেশে যাইনি, মাকে ভাই বোনদের দেখিনি। চলোনা দেশে যাই।
যাবি বাপ, দেশে যাবি, চল তবে আজ ই যাই।
ট্রেনে ভ্যান্ডার কামরায় উঠলো ওরা।
বাপজান, দেখবে আমি কেমন ম্যাজিক জানি।
কি ম্যাজিক রে বাপ?
দেখবে টেরেন চলবে আর আমি জানলা ধরে ধরে এগিয়ে যাব, আবার তোমার কাছে চলে আসব।
না বাপ ওরকম গিয়ে কাজ নেই। টেরেন চলছে আর তুই পড়ে যাবিরে। টেরেনকে ভরসা নেইরে বাপ। তোর ম্যাজিক দেখানো ছাড়ান দে। আমার লাগবেনি ম্যাজিক। তুই এসে বস। ওসমানের ছেলে কোনো কথাই শুনলনা। ও জানলা ধরে এগোতে এগোতে ড্রাইভারের বগি পর্যন্ত চলে যায়। আবার ফিরে আসতে লাগলো। মাঝখানে গাড়ী ঝাকুনি খেতেই আব্বা বলে ওসমানের ছেলে লাইনের ওপরে পড়ে গেল।
হৈ হৈ করে উঠলো সবাই। আরে গেলরে ছেলেটা পড়ে মনেহয় মরে গেল রে।
ওসমান সামনের স্টেশনে নেমে দৌড়াতে দৌড়াতে এসে ছেলের মাথা কোলে নিয়ে ও আমা্য বাপরে, কত করে মানা করলুন শুনলিনি কথা। তুই বাড়ী যেতে চেইছিলিরে বাপ, মা ভাই বুনদের দেখবি বলেছিলি, কথা ক বাপ , আমি তোরে দেশে নে যাবরে বাপ।
ডোম এসে বডি নিয়ে গেল। অনেক হাটাহাটি করে শিয়ালদা মর্গ থেকে বডি বের করে জালালকে গোর দিয়ে এল ওসমান মিঞা।
। সন্ধ্যের ট্রেন ধরে বাড়ী চলে গেল ওসমান মিয়া।
জালালের বাপ, জালালকে কোথায় থ্যুইয়ে এলে তুমি ? সে আসেনি দেখতিছি?
সে ভালো জায়গায় আছে।
কোন ভালো জায়গায় শুনি?
তাকে আল্লার কাছে রেখে এসিছি।
মানে, ঠিক করি বলোতো তারে যে কোলকেতায় নে গেলে তাকে কোন আল্লার কাছে রেখে এলে শুনি?
শোনো, জালালের মা তোমার ছেলে বেচে নেই। সে টেরেনের ধাক্কা লেগে মরে গেছে। এইতো তাকে গোর দিয়ে টেরেন ধরে আসছি।
ওরে আমার বাপ জালাল রে। কোথায় গেলি তুই আমাকে ছেড়ে। তোর জন্য ভাত রেধে রেখেছিলুমরে বাপ। এখন কে ভাত খাবে রে,,,।
ওসমান বল্ল কেদে কি লাভ বৌ। আমি তোকে আসছে বছর তোর কোল ভরিয়ে দেব। কাদিসনি চল্ শুতে চল্ । ছানারা শুয়ে পড়েছে?
হ্যা, অনেকক্ষন আগে তারা শুয়ে পড়েছে। তাহলে তাড়াতাড়ি শুতি চল্, আসছে বছর তোর কোল ভরাবার ব্যাবস্হা করতি হবেতো। চল্ চল্
Comments
Post a Comment
Thanks for comments